ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা নিয়ে চলচ্চিত্র
৮টি চলচ্চিত্রের এই সেটটি ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা (ফরব)-এর মধ্যে কি কি অন্তর্ভূক্ত এবং কখন সেখানে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তা বুঝতে সাহায্য করবে।
অধ্যয়ন এবং জ্ঞান ভাগাভাগির একটি দারুন পন্থা চলচ্চিত্র। আমাদের সংক্ষিপ্ত ’ব্যাখ্যাকারী’ চলচিত্রগুলি ব্যক্তিগত অধ্যয়ন, অনলাইন কর্মী প্রশিক্ষণ বা দলীয় প্রশিক্ষণের জন্য আদর্শ জ্ঞানভান্ডার। কিংবা অংশগ্রহণকারীদের সশরীরে প্রশিক্ষণের আগে চলচ্চিত্র দেখে পূর্বপ্রস্তুতি নিতে বললেও মন্দ হয় না!
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা – ভূমিকা
এটি চিন্তা, বিবেক, ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত মানবাধিকার বিষয়ক ধারাবাহিক আটটি উপস্থাপনার প্রথম উপস্থাপনা। এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকায় ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার আওতাভুক্ত মানবাধিকারগুলো কী কী এবং এই অধিকারগুলোর মাধ্যমে কাদেরকে এবং কী কী বিষয়কে সুরক্ষিত করা হয়েছে সেসব বিষয়সমূহ তুলে ধরা হয়েছে।
একটি প্রশ্ন দিয়ে শুরু করা যাক! ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার মানবাধিকারের মাধ্যমে কোন কোন ধর্মকে সুরক্ষিত করা হয়েছে?
আপনার কি মনে হয়, পৃথিবীর বড় ধর্মগুলোই শুধু এই মানবাধিকারের মাধ্যমে সুরক্ষিত?
নাকি ছোট ও অপ্রচলিত ধর্মসহ সব ধর্মই?
অথবা সম্ভবত সব ধর্ম ও সব ধরনের বিশ্বাস?
আসলে প্রশ্নটিই জটিল? প্রশ্নটি ছিল- কোন কোন ধর্মগুলো সুরক্ষিত? মানুষ অনেক সময় মনে করে, ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা ধর্ম ও বিশ্বাসকে সুরক্ষিত রাখে, কিন্তু বাস্তবে তা বুঝায় না! অন্যান্য সমস্ত মানবাধিকারের মত ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাও মানুষকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে, কিন্তু তাদের ধর্ম বা বিশ্বাসকে নয়।
যারা প্রাচীন অথবা নতুন ধর্ম, নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রচলিত কোনো ধর্ম এবং নিজ্স্ব সংস্কৃতিতে প্রচলিত নয় এমন ধর্ম বিশ্বাস করেন অথবা চর্চা করেন সেই সব মানুষকে ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা সুরক্ষা দিয়ে থাকে। মৌলিক প্রশ্নে যারা ধর্ম বিশ্বাসী নন যেমন, নিরীশ্বরবাদী, মানবতাবাদী বা শান্তিবাদী তাদেরকেও সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তারা কোন দেশের নাগরিক তা বিবেচ্য বিষয় নয়।
এমনকি ধর্ম বা বিশ্বাস নিয়ে যারা একেবারেই মাথা ঘামান না তাদেরকেও ধর্ম এবং বিশ্বাসের স্বাধীনতা সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
অন্যভাবে বললে, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা সবাইকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে! প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের কী কী সুরক্ষা বা অধিকার রয়েছে? সে সম্পর্কে জানতে আমাদের মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র এবং চুক্তিগুলো দেখা দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি হচ্ছে:
জাতিসংঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ১৮ এবং
জাতিসংঘ ঘোষিত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির অনুচ্ছেদ ১৮।
জাতিসংঘ গৃহীত দলিলপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয় এবং জাতিসংঘ ঘোষিত চুক্তি ও সনদগুলো আইনগতভাবে বাধ্যকর। এখন নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির বিষয়বস্তুর দিকে একটু দৃষ্টি দেই।
অনুচ্ছেদ ১৮
১. প্রত্যেকের চিন্তা, বিবেক এবং ধর্মের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগের অধিকার থাকবে। এই অধিকারের মধ্যে এককভাবে অথবা অন্যের সাথে সম্প্রদায়গতভাবে নিজের পছন্দমত কোনো ধর্ম অথবা বিশ্বাস পোষণ করা বা গ্রহণ করার অধিকার এবং প্রকাশ্যে অথবা গোপনে ধর্ম পালন, অনুশীলন ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে তার ধর্ম অথবা বিশ্বাস প্রকাশ করার অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
২. কাউকে এমন কোনো বাধ্যতার অধীন করা যাবে না যার ফলে নিজের পছন্দমত ধর্ম বা বিশ্বাস পোষণ বা গ্রহণ করার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
৩. কোনো ব্যক্তির ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কেবল আইনের দ্বারা নির্ধারিত এমন সব বাধা-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে যেগুলো জননিরাপত্তা, জনশৃংখলা, জনস্বাস্থ্য অথবা নৈতিকতা, অথবা অন্যান্যের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আবশ্যক।
৪. এ চুক্তির রাষ্ট্রপক্ষগুলো অঙ্গীকার করছে যে, এরা মাতাপিতা এবং প্রযোজ্যক্ষেত্রে আইনসঙ্গত অভিভাবকদের স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করার স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবে মানুষের সুরক্ষা বলতে কী বুঝায়? আমাদের কী কী অধিকার রয়েছে? এখন ধর্ম ও বিশ্বাস সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে প্রদত্ত অধিকারগুলোর আওতাভুক্ত সাতটি বিষয়ের কথা বলব:
প্রথম দু’টি বিষয় ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারের মূল ধারণাকে প্রকাশ করে:
· ধর্ম বা বিশ্বাস পোষণ করা, বেছে নেওয়া, পরিবর্তন করা বা ত্যাগ করার স্বাধীনতা এবং
· ধর্ম বা বিশ্বাস চর্চা করা বা প্রকাশ করার স্বাধীনতা।
· এছাড়াও আমাদের রয়েছে ধর্ম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ থেকে সুরক্ষা এবং
· বৈষম্য থেকে সুরক্ষা লাভের অধিকার,
· ধর্ম ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে পিতামাতা ও শিশুদের অধিকার,
· এবং বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকার।
ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার আরেকটি মূল উপাদান হচ্ছে কীভাবে ও কখন এই অধিকারের প্রয়োগকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে সে বিষয়ক নিয়মকানুন।
ওয়েবসাইটে আপনি এই প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে একটি ভিডিওচিত্র পাবেন, যেখানে বাস্তব জীবনে এই অধিকারগুলোর প্রয়োগ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত: এসএমসি ২০১৮
End of Transcript
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা: ধর্ম বা বিশ্বাস পোষণ বা পরিবর্তনের অধিকার
ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রথম মৌলিক দিক হচ্ছে স্বাধীনভাবে ধর্ম বা বিশ্বাস পোষণ, ধারণ, পরিবর্তন বা ত্যাগের স্বাধীনতা। এটি একান্তই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের বিষয় এবং এটি ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার অর্ন্তনিহিত বিষয় হিসেবেই পরিচিত। ধর্ম বা বিশ্বাস পালন বা পরিবর্তনের অধিকার একেবারেই আপনার নিরঙ্কুশ অধিকার, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে এই অধিকারের উপর কখনোই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় না। আপনি খ্রিষ্টান, মুসলিম, বাহাই, ইয়েজিদী বা নিরীশ্বরবাদী যেই হোন না কেন, অথবা আপনি সিঙ্গাপুর, সুইডেন বা সুদান যেখানেই থাকুন না কেন, সেখানে শান্তি থাকুক কি যুদ্ধ, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাই বলুক না কেন – আপনিসহ প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব বিশ্বাস ধারণ ও পালন করার, বা পরিবর্তন করার, কিংবা নিরীশ্বরবাদী হওয়ার অধিকার রয়েছে।
অবশ্য অনেক মানুষই এই নিরঙ্কুশ অধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং তাদের ধর্ম বা বিশ্বাসের জন্য সরকার, পরিবারের সদস্য বা সমাজের মানুষের দ্বারা হামলার শিকার হন বা শাস্তি ভোগ করেন।
কোনো কোনো সরকার কোনো বিশেষ ধর্ম বা বিশ্বাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে থাকে। ফালুন গঙ হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসর একটি বিশেষ ধরন এবং অনুশীলন যা চীনে নিষিদ্ধ। ফালুন গঙ অনুসারীদের কারাবাস, নির্যাতন, জোরপূর্বক শ্রম এবং তাদের নিজ বিশ্বাস ত্যাগ করার লক্ষ্যে জোরপূর্বক শিক্ষা গ্রহণের মত নিগ্রহ সহ্য করতে হয়েছে।
ইরিত্রিয়ায় মাত্র চারটি ধর্ম রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি নেই এমন ধর্মের অনুসারীদের, যেমন- পেন্টিকস্টাল খ্রিষ্টান এবং যিহোভা’স উইটনেসদের বিভিন্ন উপায়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।
কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস পালনের অধিকার লঙ্ঘনের আরও সুস্পষ্ট একটি উদাহরণ হচ্ছে ঘৃণাজাত অপরাধ, যেখানে ধর্মীয় পরিচয় বা বিশ্বাসের কারণে একজন ব্যক্তি নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। শুধুমাত্র একটি বিশেষ ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ করেন বলেই তারা আক্রান্ত হন।
২০১৫ সালে ফ্রান্সে মুসলিমদের প্রতি আক্রমণ, হয়রানি বা অপরাধজনিত ক্ষয়ক্ষতির মত ঘৃণাজাত অপরাধের পরিমাণ শতকরা ২৫০ ভাগ বেড়ে যায় এবং সে বছর এ ধরনের ৩৩৬টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়। এদিকে ইহুদী সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণাজাত অপরাধের উচ্চমাত্রা বজায় ছিল, এ সংক্রান্ত নথিভুক্ত ঘটনার সংখ্যা ছিল ৭১৫টি।
মেক্সিকোর প্রত্যন্ত কিছু কিছু অঞ্চলে প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানরা তাদের এলাকার স্থানীয় নেতাদের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন বা নিজের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন, কারণ সেই নেতারা শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী ও ক্যাথলিক ধর্মকেই সংরক্ষণ করতে চায়।
অনেক দেশেই ধর্মীয় পরিচয়, জাতিগত পরিচয় এবং রাষ্ট্রীয় পরিচয় একটি অন্যটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেসব ক্ষেত্রে যারা বড় কোনো ধর্ম বিশ্বাস ত্যাগ করে সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করে অথবা যারা নিরীশ্বরবাদী, তাদেরকে অনেক সময় রাষ্ট্রদোহী অথবা জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস ত্যাগ করার নিরঙ্কুশ অধিকারকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়।
ইন্দোনেশিয়ায় ধর্মীয় স্বাধীনতার আইন রয়েছে, যদিও তা নির্দিষ্ট কিছু ধর্ম যেমন- ইসলাম, ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ধর্ম, কনফুশিয়ানিজম এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষকে সুরক্ষা দিয়ে থাকে। নিরীশ্বরবাদ এই আইনের আওতায় সুরক্ষিত নয়। ফেইসবুকে নিরীশ্বরবাদ সম্পর্কিত পেইজ খোলা এবং “ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব নেই” লেখার অভিযোগে মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া ৩০ বছর বয়সী এ্যালেক্স এ্যান আড়াই বছরের কারাবাস এবং ১১,০০০ মার্কিন ডলার জরিমানা প্রদানের মত শাস্তি পেয়েছেন।
এ্যানের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টির লক্ষ্যে গুজব রটানো, ইন্টারনেটে ধর্মদ্রোহিতামূলক বার্তা ছড়ানো এবং অন্যদেরকে নিরীশ্বরবাদী হওয়ার আহ্বান জানানোর অভিযোগ ছিল। এ্যান তার ফেসবুক পেইজে প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করার পরও তাকে উন্মত্ত জনতার হাতে মার খেতে হয়েছে এবং তাকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।
ইরানে কোনো ব্যক্তি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তাকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়, বিশেষ করে যদি তিনি কোনো অনিবন্ধিত ঘরোয়া গীর্জার সাথে জড়িত থাকেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে এমন চার জন ধর্মান্তরিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে “জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘন” করার অভিযোগ এনে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এর আগে তাদের মধ্যে তিনজনকে খ্রীষ্ট ধর্মীয় রীতি অনুসারে ওয়াইন পান করার অপরাধে ৮০ ঘা চাবুক মারা হয়েছিল, কারণ সরকার তাদেরকে তখনো মুসলিম হিসেবেই গণ্য করছিলো এবং ইরানে মুসলিমদের জন্য মদ্যপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সংখ্যাগুরু ধর্ম ত্যাগ করা বা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বা শাস্তির সমর্থনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা অনেক সময় ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি বা ধর্মীয় প্রথাগত আইনকে নিজেদের সুবিধামত ব্যাখ্যা করে থাকেন। এসব শাস্তির মধ্যে থাকতে পারে মৃত্যুদণ্ড, কারাদণ্ড, চাকরি থেকে বরখাস্ত অথবা দাম্পত্য সম্পর্কের বিচ্ছেদ এবং সন্তান লালন-পালনের অধিকার হারানো। সৌদি আরব এবং পাকিস্তানসহ বেশ কিছু মুসলিমপ্রধান দেশে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার ক্ষেত্রে এ ধরনের আইনানুগ বিধিনিষেধ রয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এমন নয়। যেমন, সিয়েরা লিওনে মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ মুসলিম ও ২০ ভাগ খ্রিষ্টান। সেখানে ধর্ম সর্বজনীন, তাতে রাজনীতির কোনো প্রভাব নেই এবং এক ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা।
তবে এ ধরনের সমস্যা কেবল মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ নয়। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের কিছু কিছু অঞ্চলে তথাকথিত এ্যান্টি-বলাকা সামরিকজান্তা সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রাণহানির ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করছে। ভারতের একাধিক রাজ্যে আইন করে ধর্ম পরিবর্তনের অধিকার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি তার ধর্ম পরিবর্তন করতে চাইলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি গ্রহণের বিধান করা হয়েছে।
এই অধিকার শুধুমাত্র সরকারই ক্ষুণ্ন করছে তা নয়। ভারতে সহিংস ধর্মীয় দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে যেখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদী কয়েকটি দল সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান ও মুসলিমদের উপরে আক্রমণ চালিয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছে। অনেক সময় সহিংসতার ফলে বসতবাটী থেকে বিতারিত মানুষদেরকে ধর্মান্তরিত হতে রাজি হলে তবেই তাদের ফিরে আসতে দেওয়া হয়।
শুধু যে ধর্মের অনুসারি ব্যক্তিরাই এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তা নয়। যারা ধর্মীয় মতবাদ বা ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে সমালোচনা করেন তারাও বিভিন্ন বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় মতবাদ, চর্চা এবং রাষ্ট্রকে নিয়ে সমালোচনা করার জন্য বাংলাদেশের একাধিক ব্লগার মৌলবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন। দুঃখজনকভাবে, সহিংস মৌলবাদী দলগুলোকে নিষ্ক্রিয় করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা এখনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। কোনো কোনো সরকার ধর্মীয় ভাবনার সমালোচনাকারীদের উপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়। এই নীরবতা ‘সহিংসতা সমর্থনযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য’ এমন বার্তাই দেয়।
ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুবই বিতর্কিত একটি বিষয়। বস্তুত, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো যখনই একটি নতুন চুক্তি বা ঘোষণায় সম্মত হয়েছে, সেখানে ধর্ম পরিবর্তনের অধিকারের বিষয়টি দুর্বলভাবে অর্ন্তভুক্ত হয়েছে।
কিন্তু জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি যাদের কাজ হচ্ছে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক চুক্তির ব্যাখ্যা সম্পর্কে রাষ্ট্রগুলোকে পরামর্শ দেওয়া, তাদের মতে, “কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস ‘ধারণ করা বা গ্রহণ করার’ স্বাধীনতা অনিবার্যভাবে কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস বেছে নেওয়ার স্বাধীনতার পাশাপাশি একজন ব্যক্তির বর্তমান ধর্ম বা বিশ্বাস ছেড়ে ভিন্ন কোনো ধর্ম বা বিশ্বাস অথবা নিরীশ্বরবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের স্বাধীনতা এবং সেই সাথে বর্তমান ধর্ম বা বিশ্বাসে স্থির থাকার স্বাধীনতাকেও বোঝায়।”
সংক্ষেপে বলতে গেলে –ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ অথবা পরিবর্তনের নিরঙ্কুশ অধিকার আপনার রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই তা নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। তথাপি, কোনো কোনো রাষ্ট্রের সরকার এই অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে কোনো বিশেষ ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা গ্রহণের জন্য পরিবার বা সমাজ কর্তৃকও বিভিন্ন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
এই ওয়েবসাইটের প্রশিক্ষণ উপকরণসমূহ থেকে ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা পরিবর্তনের অধিকার এবং এ সম্পর্কিত মানবাধিকার দলিলসমূহ সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন ।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত: এসএমসি ২০১৮
End of Transcript
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা– ধর্ম ও বিশ্বাস প্রকাশের অধিকার
ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার দ্বিতীয় মৌলিক উপাদানটি হচ্ছে শিক্ষাদান, চর্চা, উপাসনা ও উদযাপনের মধ্য দিয়ে আপনার বিশ্বাসকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা। এটি ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার বাহ্যিক দিক হিসেবে পরিচিত। তবে ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা পালনের অধিকারের মত প্রকাশের অধিকার নিরঙ্কুশ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অধিকারকে সীমিত করা যেতে পারে।
প্রকাশ করার অর্থ হচ্ছে ধর্মীয় বিশ্বাসকে কথায় ও কাজে ব্যক্ত করা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে প্রকাশ্যে বা গোপনে, একাকী বা দলবদ্ধভাবে ধর্মীয় বিশ্বাস প্রকাশের অধিকার মানুষের রয়েছে।
আপনি ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থনা করতে পারেন এবং উপাসনা ও আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে আপনার ধর্ম বা বিশ্বাসকে প্রকাশ করতে পারেন।
এই সম্প্রদায়েরও অধিকার আছে – তবে তার সদস্যদের উপর নয়, বরং রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অধিকার। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে, ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিক কোনো সম্প্রদায় আইনগত পরিচয় লাভ করতে চাইলে রাষ্ট্র তাদের এই অধিকার নিশ্চিত করবে, যাতে তারা ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলতে পারে, মানুষকে কাজে নিযুক্ত করতে পারে, স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা পেতে পারে এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে।
ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী নানা উপায়ে তার ধর্ম বা বিশ্বাস চর্চা বা প্রকাশ করতে পারে এবং জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এমন অনেক উদাহরণ দিয়েছেন যেগুলো এই অধিকার দ্বারা সুরক্ষিত:
– উপাসনায় অংশগ্রহণের জন্য একত্রিত হওয়া, উৎসব উদযাপন এবং বিশ্রাম পালন করা।
– ধর্মীয় পোশাক পরিধান করা ও বিশেষ খাবার গ্রহণ করা।
– উপাসনার স্থান ও কবরস্থানের সত্ত্বাধিকার এবং ধর্মীয় প্রতীক প্রদর্শন করা।
– সামাজিক দায়িত্ব পালন, যেমন দাতব্য প্রতিষ্ঠান গঠন করা।
– ধর্ম বা বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করা, শিক্ষা প্রদান করা এবং ধর্মীয় নেতাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা বা নিযুক্ত করা।
– নিজ বিশ্বাস সম্পর্কে সাহিত্য রচনা, প্রকাশ এবং বিতরণ করা
– এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্বাস সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা।
– স্বেচ্ছামূলক অনুদানও গ্রহণ করা যেতে পারে।
এ পর্যায়ে আপনি বলতে পারেন – দারুন, আমি চাই আমার সম্প্রদায়েরও ঠিক এই অধিকারগুলো থাকবে!
আপনি হয়তো কিছুটা চিন্তিতও হয়ে পড়েছেন! যে দলগুলো তাদের সদস্যদের দমিয়ে রাখে ও নিয়ন্ত্রণ করে, বা অন্যদের প্রতি ঘৃণা ও সহিংসতা ছড়ায় তাদের কী হবে? তাদের কি নিজেদের বিশ্বাস প্রচার করা এবং চর্চা করার স্বাধীনতা রয়েছে?
এর প্রেক্ষিতে আমার কাছে দুটি উত্তর রয়েছে :
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি’র ৫ নং অনুচ্ছেদের মাধ্যমে কোনো একটি অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে অন্য একটি অধিকারকে লংঘন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কাজেই ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা কোনো রাষ্ট্র, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অন্যের উপরে বলপ্রয়োগ, সহিংসতার প্রশ্রয় বা সহিংস আচরণের অনুমতি দেয় না।
হ্যাঁ, অনেক দেশের সরকার এবং বিভিন্ন গোষ্ঠী বলপ্রয়োগ বা নিপীড়ন করে থাকে। কিন্তু ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা তাদেরকে এই অধিকার দেয় না। বরং এই অধিকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা নিপীড়ন ও সহিংসতার শিকার হয় তাদেরকে সুরক্ষা দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, আপনার বিশ্বাস ধারণ ও বেছে নেওয়ার অধিকারের উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় না, কিন্তু ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশ ও চর্চার অধিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। কিন্ত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি’র ১৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেবলমাত্র নিম্নোক্ত চারটি শর্ত পূরণ করার পরই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে:
নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই হতে হবে আইনের আওতায় আরোপিত, অন্যদেরকে সুরক্ষা দানের জন্য অপরিহার্য, বৈষম্যহীন এবং কোনো সমস্যা নিরসনের যৌক্তিক সমাধান।
এই শর্তগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই শর্তগুলো না থাকলে সরকার তার অপছন্দের যেকোনো গোষ্ঠী বা চর্চার উপর খেয়াল মত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
নিষেধাজ্ঞা হওয়া উচিত সর্বশেষ পন্থা, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার নয়। দুঃখজনক হল, অনেক সরকারই এই শর্তগুলো উপেক্ষা করে এবং ধর্ম প্রকাশের অধিকার লঙ্ঘনের অগণিত উদাহরণ আমরা দেখতে পাই।
নিবন্ধনের উপর নিষেধাজ্ঞামূলক আইন একটি বড় সমস্যা। অনেক দেশের আইনে ধর্মীয় নিবন্ধন বাধ্যতামূলক এবং ধর্ম বা বিশ্বাসের চর্চা নিবন্ধনের উপর নির্ভরশীল যা আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন হিসেবে বিবেচিত। নিবন্ধন কখনো ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হতে পারে না। বরং কোনো সম্প্রদায় চাইলে যাতে আইনগত পরিচয় লাভ করতে পারে সেটিই নিবন্ধনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
যেসকল রাষ্ট্র অনিবন্ধিত ধর্মীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে সেসব রাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণমূলক এমন আইনও রয়েছে যা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিবন্ধনের সক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলে । যেমন, কাজাখিস্তানে অনিবন্ধিত ধর্মীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ এবং অনেক গোষ্ঠীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। সেখানে নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে অন্য কারও সাথে ধর্ম নিয়ে কথা বলা বেআইনী এবং সমস্ত ধর্মীয় সাহিত্য ব্যবহার করার আগে অবশ্যই সরকারি ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। এগুলো সব ধর্মীয় সম্প্রদায়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সরকার বিভিন্নভাবে ধর্মচর্চায় বাধা সৃষ্টি করে থাকে। ভিয়েতনাম সরকার রাস্তায় চেকপয়েন্ট বসিয়েছে যাতে করে হোয়া হাও বৌদ্ধরা তাদের প্যাগোডাতে যেতে না পারে। সৌদি আরবে অমুসলিমদের প্রকাশ্যে উপাসনা করা নিষিদ্ধ এবং কিছু অভিবাসী কর্মীকে সমবেত উপাসনায় হামলার অভিযোগে গ্রেফতার করে নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। চীন এবং ইন্দোনেশিয়ার কিছু এলাকায় কর্তৃপক্ষ চার্চ ভেঙ্গে দিয়েছে।
রাশিয়ার উগ্রপন্থাবিরোধী আইনের আওতায় হাজার হাজার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রকাশ করে এমন অনেক প্রকাশনা রয়েছে। কোনো একটি নির্দিষ্ট বই নিষিদ্ধ কিনা সেটা খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার, কিন্তু যদি তা কারও সংগ্রহে পাওয়া যায় তাহলে এর শাস্তি হতে পারে জরিমানা, কারাদণ্ড বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে বহিষ্কার করা। কোন ধর্মবিশ্বাস প্রচার করা যাবে? করা গেলে কোথায় করা যাবে? এবং কে করতে পারবে? এসব ব্যাপারেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ফ্রান্সে কোনো কোনো শহরের মেয়র জননিরাপত্তার নামে বারকিনি নামের একটি সাঁতারের পোশাকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন, যা মুখমন্ডল বাদে বাকি সমস্ত দেহ আবৃত করে রাখে। সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত শেষ পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা আইন খারিজ করে দিলেও প্রকাশ্যে মুখ ঢাকা পোশাক পরিধানের উপর নিষেধাজ্ঞা এখনও রয়েছে। এছাড়া কিছু কিছু ইউরোপীয় দেশে ইসলামিক এবং ইহুদী পন্থায় মাংস জবাই নিষিদ্ধ।
ধর্ম প্রকাশের অধিকার সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দলের কার্যক্রমের মধ্য দিয়েও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ৯টি ইউরোপীয় দেশের ৫০০০ এর বেশি ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে করা একটি জরিপের শতকরা ২২ জন বলেছেন, তারা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে কিপ্পার মত ধর্মীয় পোশাক প্রকাশ্যে পরিধান করা থেকে বিরত থাকেন। এছাড়া অনেক দেশেই ইহুদীদের কবরস্থানকে অসম্মানিত করা হয়ে থাকে।
মিসর, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ার কিছু কিছু স্থানে বিভিন্ন সন্ত্রাসী দল ইসলামের নামে সহিংস হামলা চালাতে পারে এই ভয়ে অনেকে সমবেত ধর্মীয় উপাসনায় অংশগ্রহণ করতে ভয় পান। অন্যদিকে মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের কিছু জায়গায় মুসলিম বিরোধী সামরিকজান্তার আক্রমণের ভয়ে শুক্রবারের সমবেত নামাজে অংশগ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের স্বাধীনতা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়কেই কথা ও কাজের মাধ্যমে তাদের বিশ্বাস প্রকাশ করার অধিকারকে সুরক্ষা দেয়। এটি ব্যক্তিগতভাবে বা প্রকাশ্যে করা যেতে পারে। কী কী ধরনের চর্চাকে সুরক্ষিত করা হয়েছে সে সম্পর্কে মানবাধিকার দলিলসমূহে বহু উদাহরণ রয়েছে, এবং গোষ্ঠীভিত্তিক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সুরক্ষা হচ্ছে আইনগত পরিচয়ের অধিকার।
ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের অধিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে কিছু কঠোর শর্ত পূরণ করতে হবে। এই শর্তগুলো হচ্ছে- নিষেধাজ্ঞাকে আইনগতভাবে বৈধ, অন্যদের সুরক্ষা দানের জন্য অপরিহার্য, বৈষম্যহীন এবং কোনো সমস্যার যৌক্তিক সমাধানের জন্য হতে হবে।
দুঃখজনক হল, বিশ্বের অনেক সরকারই এই সকল নিয়ম অনুসরণ করে না। এবং সরকার ও সামাজিক বিভিন্ন গোষ্ঠী উভয়েই ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের এই অধিকার লংঘন করে থাকে।
এই ওয়েবসাইটের প্রশিক্ষণ উপকরণসমূহ থেকে ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের অধিকার এবং এ সম্পর্কিত মানবাধিকার দলিলসমূহ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন ।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত: এসএমসি ২০১৮
End of Transcript
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম বা বিশ্বাসের– বলপ্রয়োগ থেকে সুরক্ষা
ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বলপ্রয়োগ থেকে সুরক্ষার অধিকার। বলপ্রয়োগ মানে জোর করে বা ভয় দেখিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে বাধ্য করা।
ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার একটি মৌলিক দিক হচ্ছে প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা পরিবর্তনের অধিকার আছে। অন্যভাবে বললে, ধর্ম বা বিশ্বাস এবং এর অভিব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছামূলক।
বলপ্রয়োগ থেকে সুরক্ষার অধিকার এই বিষয়টিতেই আলোকপাত করে। কোনো রাষ্ট্র, ধর্মীয় নেতা বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস বা চর্চা অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার নেই। এমনকি কারও ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ, পালন বা পরিবর্তন করানোর অধিকারও অন্য কারও নেই।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৮(২) নং অনুচ্ছেদ
“কাউকে এমন কোন বাধ্যতার অধীন করা যাবে না যার ফলে নিজের পছন্দমত ধর্ম বা বিশ্বাস পোষণ বা গ্রহণ করার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে।”
এই দিকটি রাষ্ট্রকে কেবল মানুষের উপর বলপ্রয়োগ করা থেকে বিরত রাখার কথাই বলে না, বরং সেই সাথে সমাজের অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হুমকি বা সহিংসতার হাত থেকে ব্যক্তিকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য দায়িত্বও প্রদান করে।
তথাপি সারা বিশ্বে আমরা হুমকি, সহিংসতা কিংবা জরিমানা বা কারাদণ্ডের মত শাস্তির মাধ্যমে বলপ্রয়োগের অনেক ঘটনা দেখতে পাই। বলপ্রয়োগ খুব সুক্ষ্মভাবে সংঘটিত হতে পারে, যেমন ধর্মান্তরের বিনিময়ে চাকরির প্রস্তাব, অথবা কোনো বিশেষ ধর্ম বা বিশ্বাস ত্যাগ করলে বা গ্রহণ করতে অসম্মতি জানালে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণে বাধা দান করা।
অনেক সময় রাষ্ট্র নিজে আনুষ্ঠানিকভাবে আইনের মাধ্যমে কিংবা স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে বলপ্রয়োগে জড়িত থাকে।
বাহাই সম্প্রদায় ইরানের সর্ববৃহৎ অমুসলিম ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ১৯৭৯-র বিপ্লবের পর থেকে সরকারী নীতির আওতায় বাহাই অনুসারীদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য তাদের উপরে পদ্ধতিগতভাবে নিপীড়ন চালানো হয়েছে। বিপ্লব পরবর্তী ১০ বছরে এই সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, শত শত মানুষকে নির্যাতন বা কারাবন্দী করা হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ তাদের চাকরি, শিক্ষা ও অন্যান্য অধিকার হারিয়েছে কেবলমাত্র তাদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য।
২০১৭’র ডিসেম্বরে ইরানে ধর্মবিশ্বাসের জন্য ৯৭ জন বাহাই বিবেকের বন্দী ছিল, এর মধ্যে ছয় জন ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের বাহাই ধর্মীয় নেতা।
এই উদাহরণগুলো বৈষম্য ও বলপ্রয়োগের মধ্যে সংযোগকে তুলে ধরে। ইরানে বাহাই সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা বা সরকারী চাকুরীতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। বৈষম্যমূলক এই আইনটি বলপ্রয়োগমূলক। যখন একজন শিক্ষার্থী বা পেশাজীবীকে বাহাই ধর্মাবলম্বী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ বা পদচ্যুতির মধ্যে যে কোনো একটি বেছে নিতে হয়।
অনেক সময় সহিংস জাতীয়তাবাদী বা উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো মানুষকে জোরপূর্বক ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তন করতে বলপ্রয়োগ করে। তথাকথিত ইসলামিক রাষ্ট্র দায়েশ, ইয়েজিদি ও খ্রিষ্টান উভয় ধর্মের লোকদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেছে এবং যারা অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাদেরকে হত্যা করেছে। এদিকে ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টির মাধ্যমে জোরপূর্বক হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপারে হিন্দুত্ববাদীদের জড়িত থাকার কথা জানা গেছে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক বন্দুকের মুখে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদেরকে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করানোর প্রমাণ রয়েছে। মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের কিছু অঞ্চলে মুসলিমদেরকে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ না করলে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখানো হয়েছে।
যদিও বলপ্রয়োগের নিষেধাজ্ঞা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যক্তির ধর্ম বা বিশ্বাস পোষণ, গ্রহণ বা পরিবর্তনের সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত, তথাপি ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে অনেককে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বলপ্রয়োগের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। এ ধরনের বলপ্রয়োগের একটি উদাহরণ হচ্ছে নারীদের পোশাক। কোনো কোনো দেশে নারীদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মীয় পোশাক পরিধান করতে হয়, আবার অন্য অনেক দেশে নারীদের ধর্মীয় পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধ। নারীরা তাদের ধর্মীয় পোশাক পরিধান করলে ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করে থাকে এবং যদি তারা তা পরিধান না করেন তখন নিজ সম্প্রদায়ের কাছে তাদেরকে তিরষ্কৃত হতে হয়।
অনেক মানুষই বলপ্রয়োগের শিকার হয়ে থাকেন। অনেক দেশেই যাদের ধর্মীয় মতবাদ বা চর্চা রাষ্ট্রীয় চেতনা বা সামাজিক রীতিনীতি থেকে ভিন্ন , তাদেরকে বলপ্রয়োগের শিকার হতে হয়। সংখ্যালঘু, নিরীশ্বরবাদী, ধর্মান্তরিত বা স্থানীয় প্রেক্ষাপটে “বিদেশী” ধর্মের অনুসারীরা বিশেষভাবে বলপ্রয়োগের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে যাদেরকে স্ব-ধর্মত্যাগী, ঈশ্বর-নিন্দাকারী বা সঠিকভাবে ধর্ম পালন করছেন না বলে বিবেচনা করা হয় তাদেরকে জোরপূর্বক তাদের বিশ্বাস ও চর্চা পরিবর্তনে রাষ্ট্র, নিজ পরিবার ও সমাজ কর্তৃক বলপ্রয়োগের শিকার হতে হয়।
সার কথা হচ্ছে, বলপ্রয়োগের মধ্যে হুমকি, সহিংসতা, বৈষম্য কিংবা জরিমানা বা কারাদণ্ডের মত শাস্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং তা রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর কাছ থেকে আসতে পারে। কাউকে বলপ্রয়োগের অধীন করা যাবে না কথাটির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন শুধুমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃক বলপ্রয়োগের ব্যবহার নিষিদ্ধই করেনি, সেই সাথে বলপ্রয়োগ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে বলপ্রয়োগ প্রতিরোধ ও বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের উপরে দায়িত্ব অর্পণ করেছে।
এই ওয়েবসাইটের প্রশিক্ষণ উপকরণসমূহ থেকে বলপ্রয়োগ থেকে সুরক্ষা এবং এ সম্পর্কিত মানবাধিকার দলিলসমূহ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন ।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত: এসএমসি ২০১৮
End of Transcript
4. বলপ্রয়োগ বা জবরদস্তি থেকে সুরক্ষা
বলপ্রয়োগ মানে হচ্ছে কোনো কিছু বলতে বা করতে জোরপূর্বক বাধ্য করা। ধর্ম বা বিশ্বাসের প্রশ্নে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ না করা এবং সমাজের বলপ্রয়োগ থেকে আপনাকে সুরক্ষা দেওয়ার সরকারি দায়িত্ব সম্পর্কে এই ভিডিওতে দেখানো হয়েছে । বলপ্রয়োগ কী কী ভাবে ঘটতে পারে সে ব্যাপারে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের উদাহরণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা– বৈষম্য থেকে সুরক্ষা
ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত একটি অধিকার হচ্ছে বৈষম্য থেকে সুরক্ষার অধিকার |। বৈষম্য মানে হল, কারও বিশেষ পরিচয়ের কারণে অন্যদের তুলনায় ভিন্ন রকম আচরণ করা।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অন্যতম একটি বিধান হচ্ছে ধর্ম বা বিশ্বাসসহ অন্য যেকোনো কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক বৈষম্য করা অনুমোদিত নয়। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ২ নং অনুচ্ছেদ এবং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে এই অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, ২ নং অনুচ্ছেদ, প্যারাগ্রাফ ১
বর্তমান চুক্তির প্রতিটি রাষ্ট্রপক্ষ চুক্তিতে স্বীকৃত, অধিকারসমূহকে সম্মান দেখাবে বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান করে এবং জাত, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক অথবা অন্য মতাদর্শ, জাতীয় অথবা সামাজিক উৎপত্তি, সম্পত্তি, জন্ম অথবা অন্য কোন মর্যাদা নির্বিশেষে এর রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে এবং এখতিয়ারাধীন সকলের জন্য উক্ত অধিকারসমূহ নিশ্চিত করবে।
কাজেই ধর্ম বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ। বৈষম্যের উপরে নিষেধাজ্ঞা বলপ্রয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞারই প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র যে শুধু তার কাজের মধ্য দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি থেকে বিরত থাকবে তা নয়, সেই সাথে সমাজ থকে বৈষম্য প্রতিরোধ ও বন্ধ করতে রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
তথাপি, বৈষম্যের মাধ্যমেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা লংঘিত হয় এবং তা প্রত্যেক ধর্ম ও বিশ্বাসভিত্তিক সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
গবেষকরা দেখেছেন, সুইডেনে ইহুদীদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ২৬ ভাগ কম এবং মুসলিমদের ক্ষেত্রে তা ৩০ ভাগ । কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের ক্রুশ বা হিজাবের মত ধর্মীয় প্রতীক পরিধান নিষিদ্ধ করা আদৌ বৈষম্য কিনা এবং কখন তা বৈষম্যমূলক হয়ে ওঠে এ প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ইউরোপের বিভিন্ন আদালত ও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটিতে অসংখ্যবার উত্থাপিত হয়েছে।
বৈষম্য বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। কখনো কখনো রাষ্ট্র কর্তৃক অন্যান্য সব ধর্মের তুলনায় কোনো এক বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে হতে পারে। যেমন, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে রাষ্ট্রীয় অনুদান বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য। কখনো তা আরও গুরুতর হয়ে ওঠে এবং অধিকারকেই অস্বীকার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন কোনো সম্প্রদায়কে তাদের আইনানুগ পরিচয় ধারণ বা উপাসনালয় নির্মাণের অধিকারকে অস্বীকার করা হয়। ধর্ম বা বিশ্বাসভিত্তিক রাষ্ট্রীয় বৈষম্য শুধুমাত্র ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে না। বরং তা বিবাহ, সন্তানের অভিভাবকত্ব অথবা চাকরি, বাসস্থান, নাগরিক সেবা বা ন্যায়বিচারের মত জীবনের প্রত্যেকটি বিষয়কে প্রভাবিত করে।
অনেক দেশের পরিচয়পত্রে নাগরিকের ধর্ম উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এতে করে সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের পরিচয়পত্র ব্যবহারের সময় প্রতিবারই বৈষম্যের শিকার হওয়ার শংকা তৈরি হয়।
ইন্দোনেশিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে বিবাহ বা জন্ম নিবন্ধনের জন্য বহু দূরে যেতে হয়, কারণ স্থানীয় কর্মকর্তারা তাদের নিবন্ধন করতে অস্বীকৃতি জানান। এবং খ্রিষ্টানদের গীর্জা নির্মাণ ও সংস্কার করার অনুমতি পেতে সমস্যা পোহাতে হয়। রাষ্ট্রীয় আদালতে বারবারই খ্রিষ্টানদের পক্ষে রায় দেওয়ার পরও স্থানীয় পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই রায় উপেক্ষা করেন। কারণ কখনো কখনো তারা সহিংস উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর ভয়ে এমনটা করে থাকেন।
পাকিস্তানে বৈষম্যমূলক আইনের কারণে আহমদীয়া মতবাদ প্রচার, শিক্ষাদান বা এ সংক্রান্ত প্রকাশনা বিলি করাকে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়ে থাকে এবং আহমদীয়া অনুসারীরা তাদের ভোটাধিকারও হারিয়েছে।
কেনিয়ার মানবাধিকার সংস্থা বলছে যে, দেশটিতে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানের ফলে নিরাপত্তাকর্মীরা ব্যাপক হারে মুসলিমদের মূল লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করে তাদের উপরে আক্রমণ ও নিপীড়ন চালাচ্ছে এবং সেই সাথে যত্রতত্র গ্রেফতার, নির্যাতন, হত্যা ও গুমের মত ঘটনা ঘটছে। এবং এই অভিযোগগুলো সেখানকার সরকার অস্বীকার করছে।
মিয়ানমারের বাইশটি গ্রামে স্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের গ্রামকে মুসলিমমুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারা গ্রামগুলোতে মুসলমানদের প্রবেশ বা রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন । স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে মুসলিমদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং মুসলিমদের বিপক্ষে বিদ্বেষমূলক গুজব ছড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতি বন্ধের জন্য কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
অনেক সময় একাধিক কারণে মানুষ বৈষম্যের মুখোমুখি হয়, যেমন ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, লিঙ্গ বা বর্ণের কারণে। মানবাধিকারের ভাষায় একে বলা হয় আন্ত:শ্রেণিগত বা ইন্টারসেকশ্যনাল বৈষম্য। ফলে কোনো কোনো গোষ্ঠী তাদের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা লংঘনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। যেমন- নারী, আদিবাসী, নৃতাত্ত্বিক সংখালঘু, এলজিবিটি (LGBT) সম্প্রদায়, অভিবাসী এবং শরণার্থী।
ভারতে বিদ্যমান আন্ত:শ্রেণিগত বা ইন্টারসেকশ্যনাল বৈষম্যের উদাহরণ দেখা যাক।
হিন্দু বর্ণপ্রথা এক ধরনের স্থায়ী শ্রেণি ব্যবস্থা, যা মানুষকে উচ্চ ও নিম্ন বর্ণতে ভাগ করে। এছাড়াও বর্ণহীন মানুষেরা রয়েছে, যাদেরকে বলা হয় দলিত। দলিতরা অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্রসীমার সবচেয়ে নিম্নতর স্তরে বাস করে এবং তাদেরকে চরম সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়। যদিও বর্ণপ্রথার উৎপত্তি হিন্দু ধর্ম থেকে, তথাপি এই ব্যবস্থা সমগ্র ভারতীয় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে এবং সকল ধর্মের মানুষকেই কোনো না কোনো বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দেখা হয়। যেমন, অনেক ভারতীয় খ্রিষ্টান ও মুসলিম দলিত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সরকার বর্ণব্যবস্থা নিষিদ্ধ করে এবং ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে বর্ণবৈষম্য প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। এই ব্যবস্থায় সরকারি চাকরিতে এবং সরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলিতদের জন্য বিশেষ কোটার বন্দোবস্ত করা হয় এবং বিশেষ নাগরিক সেবা লাভের ব্যবস্থা রাখা হয়। এ পর্যন্ত শুনতে অনেকেরই ভাল লাগবে। কিন্তু এই সুযোগ সুবিধা কেবল হিন্দু, শিখ ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি দলিতদের জন্য প্রযোজ্য। খ্রিষ্টান ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত দলিতরা এই সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
খ্রিষ্টান ও মুসলিম দলিতরা তাদের গোত্র ও সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাস উভয় কারণেই সমাজে বৈষম্যের শিকার হয়। এছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা তাদের ধর্মের জন্য বৈষম্যের শিকার হয় এবং সরকারের বর্ণবৈষম্য দূর করার জন্য পরিচালিত ইতিবাচক কার্যক্রম থেকেও তারা বঞ্চিত। এতে করে খ্রিষ্টান ও মুসলিম দলিতদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সার কথা হচ্ছে, রাষ্ট্র কখনোই মানুষের ধর্ম বা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে বৈষম্য করতে পারে না। বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করা এবং জনগণকে রক্ষা করা ।
বৈষম্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এবং জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে এর প্রভাব রয়েছে। ধর্ম বা বিশ্বাসসহ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত একাধিক কারণে মানুষ বৈষম্যের শিকার হয়।
এই ওয়েবসাইটের প্রশিক্ষণ উপকরণসমূহ থেকে বৈষম্য থেকে সুরক্ষা এবং এ সম্পর্কিত মানবাধিকার দলিলসমূহ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন ।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত: এসএমসি ২০১৮
End of Transcript
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা– পিতামাতা ও সন্তান
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৮ নং অনুচ্ছেদে পিতামাতা ও শিশুদের ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট অধিকারর কথা বলা হয়েছে। বাবা-মা ও আইনগত অভিভাবকদের তাদের সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে পারিবারিক জীবন পরিচালনার অধিকার রয়েছে।
মানবাধিকার শুধু যে প্রাপ্তবয়স্কদেরই রয়েছে তা নয়! শিশুদেরও ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে – উদাহরণস্বরূপ, কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশ হওয়া এবং ধর্মীয় উৎসব বা উপাসনায় অংশগ্রহণ করার অধিকার।
বাবা-মা বা অভিভাবকের ইচ্ছা অনুযায়ী শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার রয়েছে। অভিভাবকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিশুদেরকে ধর্মীয় আনুগত্যপ্রকাশমূলক কোনো অনুষ্ঠান বা কাজে অংশগ্রহণ করানো যাবেনা এবং শিশু যখন পরিণত হবে তখন তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এই অধিকারসমূহ লঙ্ঘনের প্রচুর উপদাহরণ রয়েছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পরম্পরা অনুসারে এখনো সরকার সমাজের সবক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। যেমন, তাজিকিস্তানে ১৮ বছরের কম বয়সীদের জন্য শেষকৃত্য ব্যতীত অন্য কোনো ধর্মীয় উপাসনা বা উৎসবে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশে স্কুলগামী শিশুদের মসজিদে বা গীর্জায় যাওয়া বা গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পের মত কার্যক্রমে যোগদান করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে জেরা ও হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। সেই সাথে তাদেরকে স্কুলে প্রকাশ্যে অপদস্থ করা হয়।
সুতরাং কোনো কোনো রাষ্ট্র শিশুদের ধর্মচর্চায় বাধা দেয়। অন্যান্য অনেক রাষ্ট্র শিশুদেরকে সংখ্যাগুরু ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করার জন্য ধর্মীয় অনুশাসন ও নির্দেশ মানতে বাধ্য করে। শুধু তত্ত্বগতভাবেই নয়, বাস্তবেও স্বীকারোক্তিমূলক ধর্মীয় নির্দেশনা থেকে শিশুরা যাতে মুক্ত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকলেও এই ঘটনাগুলো ঘটছে।
তুরস্কে বেশ কিছু পরিমার্জনের পরও ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং নৈতিক শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তকে এখনো স্বীকারোক্তিমূলক ধর্মীয় নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইহুদী ও খ্রিষ্টান শিক্ষার্থীদেরকে তত্ত্বগতভাবে এই প্রক্রিয়া থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হলেও বাস্তবে তা ঘটছে কিনা সে দাবী করা কঠিন বা অসম্ভব। আলেভী, বাহাই, নিরীশ্বরবাদী বা অজ্ঞেয়বাদী পরিবারগুলোর শিশুরা বা যেসকল শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী কোনো বিশ্বাস গ্রহণ করেছে তাদেরকে জোরপূর্বক ধর্মীয় পাঠে অংশগ্রহণ করতে হয়। এই সব উদাহরণগুলোতেই অভিভাবক ও সন্তান উভয়ের অধিকার লংঘন করা হচ্ছে।
শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি) গৃহীত হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা হয়নি। শিশু অধিকার সনদে অধিকারভোগী হিসেবে শিশুদের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই সনদের ১৪ নং অনুচ্ছেদে শিশুদের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
১৪ নংঅনুচ্ছেদ অনুসারে একাধারে স্বাধীন এবং অরক্ষিত হিসেবে, বিশেষত রাষ্ট্রীয় পরিসরে শিশুদের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারের চর্চার জন্য অভিভাবকের সহায়তা ও নির্দেশনার প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে।
এই সনদে বলা হয়েছে যে, শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থের নীতিই শিশুদের বিষয়ে সমস্ত কিছুর মূল চালিকাশক্তি। এছাড়া শিশুদেরকে যেসকল বিষয় প্রভাবিত করে তার প্রত্যেকটির ব্যাপারে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকারের উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তথাপি অনেক ক্ষেত্রেই বয়োজেষ্ঠ্যরা বিশেষ করে পিতা মাতা শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থের বিষয়টি নির্ধারণ করে থাকেন এবং শিশুদের পক্ষে কথা বলেন।
অবশ্য কখনো কখনো শিশু ও অভিভাবকের স্বার্থ ভিন্ন হতে পারে। সেসব ক্ষেত্রে শিশুদের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারের সাথে অভিভাবকের অধিকারের ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন।
উদাহরণস্বরূপ, একজন শিশু কত বছর বয়সে তার ধর্মচর্চা বা বিশ্বাসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে? যেমন, তারা গীর্জায় যেতে চায় কিনা?
শিশু অধিকার সনদ অনুসারে ধর্ম বা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অভিভাবকের নির্দেশনা শিশুর পরিবর্তনশীল সক্ষমতার সাথে সঙ্গতি রেখে প্রদান করতে হবে। অন্যভাবে বললে, শিশুরা বয়সে যত বড় ও পরিণত হবে, ততই তাদের আরও বেশি করে স্বাধীনতা থাকা উচিত।
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সাবালকত্ব প্রাপ্তির বয়স ১৮ বছর, কিন্তু একটি শিশুর স্বাধীনতা এবং মানসিক পরিপক্কতা অর্জনের বিষয়টি সংস্কৃতি ও প্রেক্ষাপট বিশেষে ভিন্ন রকম হয়। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আইন নিয়ম কানুন রয়েছে। যেমন, সুইডেনে কোনো শিশুর বয়স ১২ বছর হলে, তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্য করা যায় না।
শিশু অধিকার সনদে শিশুদের প্রতিপালন বিষয়ে অভিভাবকদের জন্য সর্বজনীন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে – ধর্ম বা বিশ্বাসের চর্চা শিশুর শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য বা শিশুর বিকাশের কোনো ক্ষতির কারণ যেন না হয়।
অভিভাবকদের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারের বিপরীতে সন্তানের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকার নিয়ে কোনো মামলা সহসা আদালতে ওঠেনা। তবে এ ধরনের একটি উদাহরণ হচ্ছে যিহোভা’স উইটনেস সম্প্রদায়ের শিশুদেরকে রক্ত গ্রহণে বাধা দেওয়ার অধিকার, যেক্ষেত্রে আদালত অভিভাবকের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারের বিপরীতে শিশুর জীবনের অধিকারের সপক্ষে রায় দিয়েছে।
সারবস্তু হচ্ছে, এই ভিডিওতে আমরা পিতামাতা ও শিশুদের অধিকার সম্পর্কে জানলাম।
শিশুদের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে এবং পিতামাতার অধিকার রয়েছে তাদের নিজ বিশ্বাস অনুসারে সন্তানদের প্রতিপালন করার। তবে এই অধিকারের প্রয়োগ শিশুর ক্রমবর্ধনশীল পরিপক্কতা অর্জনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত এবং ধর্ম বা বিশ্বাসের চর্চা কোনোভাবেই যাতে শিশুর শারীরিক বা মানসিক স্বাস্থ্য বা বিকাশের ক্ষতি করতে না পারে। এই অধিকার লংঘনের কিছু উদাহরণের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্র কর্তৃক শিশুদেরকে ধর্মচর্চায় বাধা দেওয়া এবং রাষ্ট্র কর্তৃক সংখ্যালঘু শিশুদের উপর সংখ্যাগুরু ধর্মের নির্দেশ চাপিয়ে দেওয়া।
এই ওয়েবসাইটের প্রশিক্ষণ উপকরণসমূহ থেকে পিতামাতা এবং শিশুদের ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকার এবং এ সম্পর্কিত মানবাধিকার দলিলসমূহ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন ।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত: এসএমসি ২০১৮
End of Transcript
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা – বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকার
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৮ নং অনুচ্ছেদে ধর্ম ও বিশ্বাসের পাশাপাশি চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকেও সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকার ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতারই অংশ।
বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অর্থ হচ্ছে আপনার জন্য অন্যথায় করণীয় কিন্তু আপনার বিবেক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সংঘাতময় বলে কোনো কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানো।
যে সকল কাজ প্রত্যাখ্যান করার অধিকার মানুষের আছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ, শপথ নেওয়া, রক্ত দেওয়া বা নেওয়া অথবা কোনো চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া। বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর শুধুমাত্র একটি ক্ষেত্রের কথা জাতিসংঘের দলিলপত্রে উল্লেখ আছে, তা হল সামরিক বাহিনীতে যোগদান প্রত্যাখ্যান করা। তবে বাধ্যকর কোনো জাতিসংঘ চুক্তি বা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে এর উল্লেখ নেই। বরং তা জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি প্রদত্ত ২২নং সাধারণ মন্তব্যে উল্লেখ রয়েছে। এই সাধারণ মন্তব্যের মাধ্যমে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৮ নং অনুচ্ছেদকে একটি রাষ্ট্র কীভাবে ব্যাখ্যা করবে তার ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। কমিটি এই মন্তব্যে ব্যাখ্যা করে বলেছে যে, অনুচ্ছেদ ১৮ সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে অসম্মতি জানানোর অধিকারকে সমর্থন করে , যদি কাউকে হত্যা করা ব্যক্তির বিবেকের স্বাধীনতা এবং ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের অধিকারের সাথে সাংঘাতিকভাবে বিরোধপূর্ণ হয়।
অনেক দেশ এই অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং রাষ্ট্রীয় সেবা ব্যবস্থায় দায়িত্ব পালনের বিকল্প উপায় এবং অব্যাহতির বন্দোবস্ত করে। কিন্তু তারপরও এমন অনেক দেশ আছে যেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস বা শান্তিবাদী বিশ্বাসের কারণে কেউ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এক্ষেত্রে যিহোভা’স উইটনেস সম্প্রদায়কে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বলা যেতে পারে। যেমন, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ কোরিয়ায় বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর কারণে ৩৮৯ জন যিহোভা’স উইটনেস অনুসারীকে কারাভোগ করতে হয়েছিল।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, যারা সামরিক বাহিনীতে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানাবে তাদের প্রত্যেকের জন্য নির্বিশেষে বেসামরিক বিকল্প সেবাদানের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া উচিত। সেই সাথে, যারা সামরিক সেবার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকার এবং কীভাবে এই অধিকার দাবী করা যায় সেই তথ্য জানার সুযোগ থাকা উচিত। বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবহিনীতে নিযুক্ত ব্যক্তি ও স্বেচ্ছাসেবকদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানের আগে বা পরে অসম্মতি জানানোর সুযোগ থাকা উচিত।
সামরিক বাহিনীতে যোগদানে অসম্মতি ছাড়াও আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকার প্রায়শই জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত হয়। এগুলো মূলত স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পর্কিত, যেমন ধাত্রী ও চিকিৎসকরা গর্ভপাত করানোর মত কাজ প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। কিছু দেশে সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহের ক্ষেত্রে বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। কখনো কখনো পাস্পরিকভাবে সাংঘর্ষিক বিাভন্ন অধিকারের বিষয়ে জটিল প্রশ্নেরও উদ্ভব হয়ে থাকে, যেমন বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকারের সাথে যখন নারী অধিকার বা বৈষম্য-বিরোধী আইনের বিরোধ দেখা দেয়।
বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর এ ধরনের বিষয়ে এখনো আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট কোনো কাঠামো নেই। বস্তুত বিষয়টি খুবই বিতর্কিত।
এ প্রসঙ্গে সাধারণত নিম্নোক্ত তিন ধরনের বক্তব্য শোনা যায়:
কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকার হচ্ছে আপনার ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ ও পালনের নিরঙ্কুশ অধিকারেরই একটি অংশ, যা কখনোই নিয়ন্ত্রণযোগ্য নয়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, নিজ বিবেককে অনুসরণ করার পরিণাম কখনো কোনো শাস্তিভোগ হতে পারে না। সর্বোপরি, একই সাথে একজনের পক্ষে শান্তিবাদী এবং সৈনিক হওয়াটা অসম্ভব। কাজেই শান্তিবাদী একজন মানুষকে জোর করে সৈনিক হতে বাধ্য করলে তার ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ ও পালনের নিরঙ্কুশ অধিকার লংঘিত হয়।
অনেকে বলেন, এটি নিরঙ্কুশ অধিকার বটে, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতাও গুরুত্বপূর্ণ। তারা যুক্তি দেখান যে, বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ব্যক্তি, কারাবন্দী এবং অন্যান্যরা যাদের নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে কোনো পছন্দ/মতামত নেই, তাদেরকে কখনোই জোর করে তাদের বিবেকের লংঘন করার জন্য বাধ্য করানো উচিত নয়। কিন্তু যারা স্বেচ্ছায় কোনো চাকরীর জন্য আবেদন করে এবং চাইলেই চাকরি ছেড়ে দিতে পারে, তারা এটা প্রত্যাশা করতে পারে না যে, তাদের নিয়োগকর্তা তাদের বিবেকের সাথে মানিয়ে নেবেন। অন্যভাবে বললে, বিবেক অনুসরণ করে কোনো কাজ করলে সেটার জন্য কিছুটা মূল্য দিতে হতে পারে।
আবার অনেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন, বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানো একটি কাজ এবং সে কারণে এটি আপনার বিবেক, ধর্ম বা বিশ্বাসের প্রকাশ। এই প্রকাশ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে, কিন্তু সেটা শুধুমাত্র অন্যের স্বাধীনতার সুরক্ষা, জননিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বা নৈতিকতার প্রয়োজনে। সামারিক বাহিনীতে যোগদানের ক্ষেত্রে বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতির প্রসঙ্গ আসলে এটি বলা গুরুত্বপূর্ণ যে, জাতীয় নিরাপত্তা কখনো মানুষের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার বৈধ ভিত্তি হতে পারে না।
এই মতামতগুলোর মধ্যে কোনটি যথার্থ সে বিষয়ে আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে।
সার কথা হচ্ছে, এই ভিডিওতে আমরা বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকার সম্পর্কে জানলাম। বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর মানে হল সাধারণভাবে আপনার কাছ থেকে প্রত্যাশিত এমন কোনো কাজ করতে প্রত্যাখ্যান করা। সামরিক বাহিনীতে যোগদানে অসম্মতি জানানোর অধিকারকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে। অনেক দেশ এই অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু অন্যান্য অনেক দেশ বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর জন্য কারাদণ্ড প্রদান করে। বিবেকের প্রশ্নে আরও বিভিন্ন ধরনের অসম্মতিকে অনেক রাষ্ট্র জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি দেয়। তবে এই অধিকারগুলো বিতর্কিত এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন এখনো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি।
এই ওয়েবসাইটের প্রশিক্ষণ উপকরণসমূহ থেকে বিবেকের প্রশ্নে অসম্মতি জানানোর অধিকার এবং এ সম্পর্কিত মানবাধিকার দলিলসমূহ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন ।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত: এসএমসি ২০১৮
End of Transcript
স্ক্রিপ্ট: ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ
টিভিতে খবর দেখে বা আপনার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো আপনি জেনে থাকবেন যে, অনেক সরকারই ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার উপরে নিয়ন্ত্রণ বা সীমাবদ্ধতা আরোপ করে থাকে। তাদের যুক্তি হচ্ছে কোনো না কোনো কারণে ধর্মচর্চার প্রকাশকে নিয়ন্ত্রিণ করতে হয়। এই নিয়ন্ত্রণ আদৌ ন্যায্য এবং গ্রহণযোগ্য কিনা তা আমরা কীভাবে বুঝব?
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ, বেছে নেওয়া, পরিবর্তন বা ত্যাগের অধিকার নিরঙ্কুশ অধিকার– এই অধিকারের উপর কখনোই নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায় না। অন্যদিকে, ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের অধিকারকে কেবলমাত্র চারটি শর্ত বা নিয়মের আওতায় নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
১. যে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় আরোপ করতে হবে।
এর উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্র, পুলিশ এবং আদালত কর্তৃক অপ্রত্যাশিত ও অযৌক্তিকভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ বন্ধ করা।
২. এই নিয়ন্ত্রণ কেবলমাত্র জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য বা নৈতিকতা অথবা অন্যদের স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষায় আরোপ করার প্রয়োজন হতে পারে।
এটি গুরুত্বপূর্ণ। ভোট পাওয়ার প্রত্যাশায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের তুলনায় অন্যকে সুরক্ষা দানের জন্য নিয়ন্ত্রণ আরোপের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।
৩. নিয়ন্ত্রণ আরোপ বৈষম্যমূলক হতে পারবে না।
৪. যে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ অবশ্যই ধর্মীয় প্রকাশজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যার মাত্রার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
এই শর্ত/ বা নিয়মগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো না থাকলে সরকারের পছন্দের নয় এমন যে কোনো গোষ্ঠী বা তাদের চর্চার উপর সরকার নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সক্ষম হবে। নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে সর্বশেষ পন্থা, এটি রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো হাতিয়ার নয়।
আসুন একটি উদাহরণের মধ্য দিয়ে দেখা যাক, এই নিয়মগুলোর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে কী বুঝানো হয়েছে।
মনে করুন, কোনো একটি শহরে পাঁচটি পৃথক ধর্মীয় গোষ্ঠী আছে। তাদের প্রত্যেকেরই উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট স্থান আছে এবং সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে উচ্চ আওয়াজ হয়ে থাকে যা প্রতিবেশীরা পছন্দ করেন না! কিন্তু পুলিশ কেবল একটি ছোট, অ-জনপ্রিয় গোষ্ঠীর ব্যাপারে অভিযোগ পেল…
উচ্চ মাত্রার শব্দ স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য জনস্বাস্থ্য একটি ন্যায্য কারণ হতে পারে। কাজেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এখন কী করা উচিত? জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য এখন কী ধরনের প্রযোজনীয়, বৈষম্যহীন ও সমস্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যেতে পারে?
এক্ষেত্রে যে কোনো জনসমাগমে শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সাধারণ আইন উপযুক্ত হবে। একটা আইন যা সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় ও অন্যদের সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। কোনো গোষ্ঠী যদি নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ ব্যবহার করে তাহলে তাদেরকে শব্দের মাত্রা কমাতে নির্দেশ দেওয়া বা জরিমানা করা ন্যায্য হবে। তাদেরকে একদম নীরব হতে বলা বা যেকোনো ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা মোটেও যথোপযুক্ত হবে না!
পুলিশকেও সবার প্রতি সমানভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে, যদিও তারা মাত্র একটি অ-জনপ্রিয় দলের ব্যাপারে অভিযোগ পেয়েছে।
এটি খুবই সাধারণ ও ছোট একটি উদাহরণ।
যখন আমরা ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার বড় ধরনের লংঘনের দিকে দৃষ্টি দেই , তখন আমরা সহজে বুঝতে পারি এই নিয়মগুলোকে কীভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে, কারণ যেসকল নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে সেগুলো স্পষ্টভাবেই অপ্রয়োজনীয়, বৈষম্যমূলক বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
অনেক দেশে ধর্মীয় কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত ভবনের বাইরে যে কোনো ধরনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ। সেক্ষেত্রে আপনার ঘরে অতিথিদের সাথে বসে খাবার খাওয়ার আগে ছোট করে ধন্যবাদের প্রার্থনা করাটাও বেআইনী! এধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ মোটেও বৈধ নয়!
তবে বিতর্কিত অনেক ঘটনা আছে। মুখমন্ডল এবং পায়ের পাতা বাদে বাকি শরীরটুকু আবৃত রাখে এমন একটি সাঁতারের পোশাক হচ্ছে বারকিনি – সেটাকে নিষিদ্ধ করা ফ্রান্সের সেই মেয়রের জন্য কি ঠিক হয়েছে? অথবা ভারতের কিছু অঞ্চলে নিজের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে অন্যের কাছে বলার অধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ কি আদৌ যুক্তিযুক্ত?
এই উপস্থাপনায় আমরা সাতটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করব যা কোনো নিয়ন্ত্রণের বৈধতা নিরূপণের জন্য প্রতিটি আদালতের বিবেচনা করা উচিত। আপনি যেসকল নিয়ন্ত্রণ বা সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হন সেগুলোকেও বিশ্লেষণ করতে এই সাতটি প্রশ্ন সহায়তা করবে বলে আশা করি।
একটি রাষ্ট্র যখন কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করে, তখন প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত এই বিধি নিষেধের মাধ্যমে ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা গ্রহণের নিরঙ্কুশ অধিকার বা ধর্মীয় আচরণ প্রকাশের অধিকার কোনটিকে খর্ব করা হয়েছে?
নিরঙ্কুশ অধিকারকে যদি খর্ব করা হয় তাহলে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ বৈধ নয়। কিন্তু যদি আচরণ প্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় তাহলে আমরা পরবর্তী প্রশ্নে যাব।
যে আচরণটির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে সেটি কি ধর্ম বা বিশ্বাসের প্রকাশ, নাকি কেবলই একটি সাধারণ আচরণ?
আমরা যে কাজগুলো করে থাকি তা অনেক সময় আমাদের বিশ্বাস দ্বারা পরিচালিত হয়। তবে আমাদের সব কাজই ধর্ম বা বিশ্বাসের সুরক্ষিত প্রকাশভঙ্গি নয়। কেউ যখন অভিযোগ করে যে, তার প্রকাশের অধিকার খর্ব করা হয়েছে, তখন আদালত বিবেচনা করে যে, তার আচরণ ধর্ম বা বিশ্বাসের প্রকাশের সাথে সম্পর্কযুক্ত কিনা। আচরণ ও বিশ্বাসের সংযোগ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আদালত দেখার চেষ্টা করে যে, তাদের মধ্যে কোনো ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে কিনা।
অনেক সময় ব্যাপারটি বেশ সহজ। গীর্জায় যাওয়া খ্রীষ্টধর্মের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত এবং রোজা রাখা ইসলামের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত।
কিন্তু সব সময় এত সহজ নয়। যেমন, কোনো একজন খ্রিষ্টানের কাছে ক্রুশ পরাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না; কিন্তু আরেকজন খিস্টানের কাছে তা ধর্মীয় পরিচয়ের এক গভীর অভিব্যক্তি। এবং মুসলিম নারীদের হিজাব নিয়ে ভিন্ন ধরনের বিশ্বাস রয়েছে।
কোন বিশ্বাসটি সঠিক সেটা নির্ধারণ করা আদালতের কাজ নয়। কোনটি ধর্মীয় আচরণের প্রকাশ সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতকে কোনো একটি ধর্মীয় মতবাদের তুলনায় অন্য একটি মতবাদকে প্রাধান্য দেওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে। মানবাধিকার ব্যক্তি বিশেষের অধিকার, তাই প্রাতিষ্ঠানিক মতবাদের পরিবর্তে আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিশ্বাসকে খতিয়ে দেখে। কেননা, যদি সংশ্লিট ব্যক্তি কোনো একটি কাজকে তার ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রকাশ বলে বিবেচনা করে থাকে, তবে তার জন্য সেটাই ঠিক।
যখন আমরা নিশ্চিত হব যে, কোনো সুরক্ষিত আচরণের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে, তখন আমাদের দেখতে হবে এই নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় আরোপ করা হয়েছে কিনা।
এই নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য কি কোনো লিখিত আইন, নজির বা প্রথাগত আইন রয়েছে? অথবা কোনো আইনগত ভিত্তি ছাড়াই কর্তৃপক্ষের দ্বারা আরোপ করা হয়েছে? যদি কোনো আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহলে এই নিয়ন্ত্রণ আরোপ বৈধ নয়।
পরবতী ধাপ হচ্ছে এই নিয়ন্ত্রণ আরোপ কোনো বৈধ কারণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন কিনা তা বিশ্লেষণ করে দেখা। এই উত্তর দেওয়ার জন্য আমাদের প্রথমে দেখতে হবে, যে আচরণ বা চর্চা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে তার সাথে কোনো বৈধ কারণের প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে কিনা এবং দ্বিতীয়ত দেখতে হবে এই নিয়ন্ত্রণ আরোপের আদৌ প্রয়োজন রয়েছে কিনা। প্রতিটি প্রশ্নই একে একে আলোচনা করা যাক।
আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার একমাত্র বৈধ কারণ হচ্ছে জননিরাপত্তা, শৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য বা নৈতিকতা এবং অন্যদের স্বাধীনতা ও অধিকারের সুরক্ষা।
সুতরাং যে আচরণটি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে সেটি কি এই কারণগুলোর একটিকেও ঝুঁকিগ্রস্ত করে তুলছে? এবং এর কি কোনো প্রমাণ আছে?
রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রিত আচরণগুলোর সাথে অন্তত একটি বৈধ কারণের প্রত্যক্ষ সংযোগ দেখাতে হবে।
হিন্দু বর্ণপ্রথায় মানুষকে উচ্চ ও ন্ম্নি বর্ণ এবং বর্ণহীন দলে ভাগ করা হয়েছে। বর্ণহীন মানুষেদেরকে চরম বৈষম্য এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। কোনো কোনো মন্দিরে বর্ণহীন হিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ভারতে ১৯৪৯ খ্রীষ্টাব্দে বর্ণপ্রথা বা শ্রেণিভেদ বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং মন্দিরগুলো এখন আর বর্ণহীন হিন্দুদের প্রবেশ করতে বাধা দিতে পারে না। এই নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে – এখানে শ্রেণিবৈষম্য প্রতিরোধ এবং অন্যদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার মধ্যে স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে।
কিন্তু সকল নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এতটা স্পষ্ট সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায় না এবং মাঝে মাঝে সরকার বৈধ কারণগুলোকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে বা অপব্যবহার করে।
ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার প্রতি নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় জনশৃঙ্খলার সাথে সম্পর্কিত থাকে। জনশৃঙ্খলা আইন অনেক বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন হুমকি, হামলা, সহিংসতার প্ররোচণা এবং কখনো কখনো ধর্মনিন্দা।
ধর্ম বা বিশ্বাস প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে মূলত আপনি যা সত্যি বলে বিশ্বাস করেন তা বলার অধিকারকে বুঝায়। বিশ্বাস শান্তিপূর্ণভাবে প্রকাশ করা যায় আবার সহিংসতার উদ্রেগকারী/ উস্কানিমূলক ভাবেও প্রকাশ করা যায়। দুঃখজনক হচ্ছে, কোনো কোনো মানুষ নিজের ধর্ম বিশ্বাস ছাড়া অন্য কারও বিশ্বাসের শান্তিপূর্ণ প্রকাশে এতটাই বিক্ষুদ্ধ হয় যে, সহিংসতার মাধ্যমে সে এর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকে।
কোনো কোনো রাষ্ট্র বিশেষ কিছু বিশ্বাসের শান্তিপূর্ণ প্রকাশকেও নিষিদ্ধ করে থাকে এবং দাঙ্গা সংঘাত সৃষ্টির ঝুঁকিজনিত জননিরাপত্তার ইস্যুকে কারণ হিসেবে দাঁড় করায়। এই যুক্তিতে ইন্দোনেশিয়ায় প্রকাশ্যে আহমদিয়া বা নিরীশ্বরবাদী বিশ্বাসের প্রকাশকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে সহিংসতার শিকার মানুষদেরকে অনেক সময় ধর্মনিন্দা বা সহিংসতার উদ্রেককারী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দায়ের করা হয় না।
এ ধরনের আইন কখনো সহিংসতা হ্রাস করতে পারে না। বরং তা এই ধারণাকে পুন:প্রতিষ্ঠিত করে যে, যারা ‘ভুল’ বিশ্বাস ধারণ করে তাদের শাস্তি পাওয়া উচিত।
আরেকটি বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে জননৈতিকতা। সবাই কি একই নৈতিক আদর্শ অনুসরণ করে এবং কার নৈতিক আদর্শ সর্বসাধারণের জন্য অনুসরণীয়? জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞগণের মতে, জননৈতিকতার সংজ্ঞা আসা উচিত “বহু সামাজিক, দার্শনিক ও ধর্মীয় প্রথা” থেকে। অন্যভাবে বললে, আপনি শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুর নৈতিক আদর্শের উপর ভিত্তি করে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেন না।
আপনি জেনে অবাক হবেন যে, জাতীয় নিরাপত্তা কখনোই ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার উপযুক্ত ভিত্তি নয়।
অনেক সরকার কোনো কোনো গোষ্ঠীকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখে থাকে, বিশেষ করে যদি সেই গোষ্ঠী কোনো শত্রু দেশে প্রবর্তিত হওয়া ধর্মবিশ্বাস অনুসরণ করে থাকে। সনদ রচয়িতারা একমত হয়েছেন যে, জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য যথেষ্ট সুযোগ দিয়ে থাকে এবং এতে জাতীয় নিরাপত্তা যোগ করলে ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সে সময় তাকে অপ্রয়োগযোগ্য করে তোলে।
সুতরাং আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি যে, বিশ্বাসের চর্চা কীভাবে কোনো বৈধ কারণকে হুমকির মুখে ফেলেছে তার স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ সংযোগ রাষ্ট্রকে দেখাতে হবে। আমরা আরও দেখলাম, বৈধ কারণগুলোকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করা হচ্ছে কিনা সেটা যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ।
এবার আমরা প্রশ্নের পরের অংশে যাই – নিয়ন্ত্রণ কি আদৌ প্রয়োজনীয়? রাজনৈতিক বা সংখ্যাগুরু দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রত্যাশিত এমনটি নয়, কিন্তু প্রয়োজনীয়।
ধরা যাক, সরকার দেখালো যে, তাদের প্রস্তাবিত নিয়ন্ত্রণের সাথে অন্যের স্বাধীনতা ও অধিকার সুরক্ষার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে।
এই হুমকি কি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার মত যথেষ্ট গুরুতর?
অন্যদের অধিকার সুরক্ষায় কি এই প্রস্তাবিত নিয়ন্ত্রণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে?
অধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে অন্য কোনো উপায়ে কি এই সমস্যার সমাধান করা যায়?
সমস্যা যদি গুরুতর না হয়, যদি প্রস্তাবিত নিয়ন্ত্রণ সমস্যা সমাধানে খুব একটা ভূমিকা না রাখে অথবা যদি নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করে সমস্যা সমাধানের অন্য কোনো উপায় থাকে, তাহলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ প্রয়োজনীয় নয়।
চীন সরকার দাবী করে যে, বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে জনসংখ্যার বাহুল্যের কারণে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকির আশঙ্কা বিরাজ করছে। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা হচ্ছে বৈধ ভিত্তি। এর একটি সমাধান হতে পারে কেন্দ্রগুলোকে সংস্কার ও প্রসারিত করা। এই সমাধানের ফলে কোনো অধিকার নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু পরিবর্তে, সরকার পুরো স্থাপনা ধ্বংস করেছে এবং জোরপূর্বক ১০০০ ভিক্ষুকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করেছে যার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
কোনো কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। জাতিসংঘ স্পষ্টভাবে বলেছে যে, ক্ষতিকর প্রথাগত চর্চা অবশ্যই নিষিদ্ধ করা উচিত, যেমন ধর্মবিশ্বাস গ্রহণের সময়কালীন কিছু রীতিনীতি এবং নারীদের লিঙ্গছেদন।
অনেক ক্ষেত্রেই মূল ঘটনাটি পরিষ্কার থাকেনা। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার প্রয়োজন রয়েছে কিনা তা প্রমাণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপরেই বর্তায়।
যখন আমরা নিশ্চিত হব যে, নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য রাষ্ট্রের বৈধ কারণ রয়েছে এবং তা প্রয়োজনও বটে, তখন আমাদের যাচাই করতে হবে এই নিয়ন্ত্রণ বৈষম্যমূলক কিনা।
আপনার মনে হতে পারে আইন, নীতি বা চর্চা বৈষম্যমূলক কিনা সেটা যাচাই করা সহজ কাজ। হ্যাঁ, যদি সেটা সকলের জন্য না হয়ে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য হয় তাহলে তা অবশ্যই বৈষম্যমূলক। একে বলা হয় প্রত্যক্ষ বৈষম্য এবং তা একেবারেই নিষিদ্ধ।
কিন্তু কোনো কোনো সময় সবার প্রতি যে আইন সমানভাবে প্রযোজ্য সেটা কোনো কোনো গোষ্ঠীর উপর বেশি প্রভাব ফেলে এবং অন্যান্যদের উপরে কোনো প্রভাবই ফেলে না। একে বলা হয় পরোক্ষ বৈষম্য।
আমাদের সেই কাল্পনিক শহরে চলুন আরেকবার ফিরে যাই, যেখানকার ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে উচ্চ আওয়াজ হয়ে থাকে। শহরের কাউন্সিল জনসমাগমে এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ে শব্দের মাত্রার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আইন প্রবর্তন করেছে। এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো সবাই সে অনুসারে তাদের স্পীকারের ভলিউম কমিয়ে নিয়েছে। কিন্তু গীর্জার ঘণ্টার শব্দ অনেক বেশি জোরালো এবং এর শব্দ কমানো যায় না। নতুন এই আইনের ফলে গীর্জার বহুদিনের প্রথাগত নিয়ম বর্জন করতে হয়েছে, কিন্তু অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়কে এই নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি।
এটি হচ্ছে পরোক্ষ বৈষম্য।
সাধারণ আইনের ফলে পরোক্ষ বৈষম্য সৃষ্টি হওয়ার এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে:
অনেক দেশে জনসাধারণের মধ্যে ছুরি বা ধারালো অস্ত্র বহন করা নিষিদ্ধ। শিখ ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর এই নিয়ম খুব একটা প্রভাব সৃষ্টি করে না। শিখ পুরুষদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে ‘কারপান’ নামের এক ধরনের ছুরি জামার নিচে বহন করতে হয়। কাজেই আইনটি এখানে শিখ পুরুষদের তাদের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা পালনের সামর্থ্যকে সীমিত করে দিচ্ছে।
কোনো কোনো দেশের পরিকল্পনা প্রবিধান অনুসারে নতুন কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে প্রতিবেশী ভবন মালিকদের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রতিবেশীদের পক্ষপাতিত্বপূর্ণ মনোভাবের কারণে প্রথাগত সম্প্রদায়গুলোর তুলনায় ছোট ও অ-প্রথাগত ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর জন্য অনুমতি পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।
নীতি ও এর চর্চা অনেক সময় সমস্যা তৈরি করতে পারে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি শনিবারে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে, তাহলে এ্যাডভেন্টিস্ট এবং প্রথাগত ইহুদী ধর্মাবলম্বীরা বঞ্চিত হয়। প্রায়শই সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী কর্মীদেরকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় উৎসবের সময় ছুটি নেওয়ার পরিবর্তে সংখ্যাগুরু ধর্মীয় উৎসবের সাথে মিলিয়ে ছুটি নিতে হয়।
প্রত্যক্ষ বৈষম্য সব সময়ই নিষিদ্ধ। কিন্তু আদালতের উচিত পরোক্ষ বৈষম্যকেও বাস্তব একটি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে যখনই যৌক্তিক উপায়ে সম্ভব তা নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া। অনেক সময় এ ধরনের সমস্যার খুব সহজ সমাধান খুঁজে বের করা সম্ভব। আমাদের কাল্পনিক শহরের কাউন্সিল ব্যতিক্রম হিসেবে রবিবারে ও ধর্মীয় উৎসবের দিনে গীর্জার ঘণ্টা বাজানোর বিশেষ অনুমতি দিতে পারেন।
সুইডেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা এর আগে শুধুমাত্র শনিবারে অনুষ্ঠিত হত। এখন তা শুক্রবারেও হয়ে থাকে। কর্মক্ষেত্রের ইউনিফর্মে পাগড়ির মত বিশেষ পোশাক অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
কিন্তু আদালতের ভাষ্য হচ্ছে, এমনটা সব ক্ষেত্রে সম্ভব নাও হতে পারে। পরোক্ষ বৈষম্য আইনসম্মত হতে পারে, যদি প্রমাণ করা সম্ভব হয় এর পেছনে যথেষ্ট ভাল ও বস্তুনিষ্ঠ যুক্তি আছে।
উদাহরণস্বরূপ, হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নীতি অনুসারে কর্মীরা কোনো ধরনের অলঙ্কার পরতে পারেন না, যা কোনো কোনো গোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে থাকে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এই নিয়মটি যুক্তিযুক্ত নিষেধাজ্ঞা।
জনস্বাস্থ্য অবশ্যই ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি বৈধ কারণ। কিন্তু পরোক্ষ বৈষম্যের ক্ষেত্রে আদালত অন্যান্য কারণও বিবেচনা করে। যেমন, একটি কোম্পানী যুক্তি দেখাতে পারে যে, তাদের নীতির পরিবর্তন করা হলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। কোনো পোশাকের দোকানে যদি নিয়ম হয় যে, তাদের বিক্রয়কর্মীদের অবশ্যই দোকানের নিজস্ব পোশাক পরতে হবে, সেক্ষেত্রে কোনো কর্মী যদি তার ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার কারণে সেই নিয়মটি প্রত্যাখান করে তবে তাকে নিয়োগ করার বাধ্যবাধকতা কোম্পানীর থাকবেনা।
কাজেই যখন প্রত্যক্ষ বৈষম্য নিষিদ্ধ, কোনো ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের প্রয়োজনে পরোক্ষ বৈষম্যকেও যতটা সম্ভব যুক্তিযুক্ত উপায়ে পরিহার করার কথা বুঝায়।
আরোপিত নিয়ন্ত্রণ বৈষম্যমূলক নয় এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা।
কোন মাত্রায় এই আচরণের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে? কার জন্য, কখন, কোথায় এবং কী নিষিদ্ধ করা উচিত?
বিশেষ কোনো কর্মক্ষেত্রে বিশেষ পেশায় নিয়োজিত কর্মীকে বিশেষ ধরনের ধর্মীয় পোশাক পরার অনুমতি না দেওয়ার সাথে রাস্তায় প্রকাশ্যে যে কোনো মানুষকে তার ধর্মীয় পোশাক পরতে না দেওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে!
কাজেই আন্তর্জাতিক আদালতগুলো সামঞ্জস্যতার দিকটিকে সতর্কতার সাথে বিবেচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালত আরও কঠোরভাবে এটার প্রয়োগ করে – যতটা সম্ভব ন্যূনতম নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করতে হবে।
একটি চূড়ান্ত দিক হচ্ছে, কিছু কিছু আদালত যে বিষয়টি বিবেচনা করে তা হল রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের সুযোগ(margin of appreciation) । এই বিশ্ব অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং মানবাধিকারের নীতি রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটের সাথে সঙ্গতি রেখে নানা উপায়ে বাস্তবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
এ কারণে কিছু কিছু আন্তর্জাতিক আদালত ‘রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের সুযোগ’ প্রয়োগ করে থাকে। মূলত এর অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপট সবচেয়ে ভালভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম এবং রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এজন্য আন্তর্জাতিক আদালত রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বাধীনতা দিয়ে থাকে।
রাষ্ট্রের বিচক্ষণতার পরিধি কতটুকু বিস্তৃত হবে এবং আদালত আদৌ এমন বিস্তৃত এখতিয়ার দেয় কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট বিতর্ক আছে!
সার কথা হচ্ছে,
কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা অনুমোদনযোগ্য কিনা, তা বিবেচনা করার জন্য আমরা নিম্নোক্ত প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করব –
১. আইনের মাধ্যমে আপনার ধর্ম বা বিশ্বাস ধারণ বা পরিবর্তনের নিরঙ্কুশ অধিকার অথবা প্রকাশের অধিকার কোনটিকে সীমিত করা হয়েছে সে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
২. যে আচরণের উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে সেটিকে সুরক্ষিত ধর্মচর্চার প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া।
৩. আরোপিত নিয়ন্ত্রণের কোন আইনানুগ ভিত্তি আছে কিনা তা যাচাই করা।
৪. এই আচরণ বা ধর্মচর্চা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার কোনো বৈধ কারণের জন্য যথেষ্ট হুমকিদায়ক কিনা, অর্থাৎ তা অন্য কারও অধিকার বা স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করছে কিনা তা বিবেচনা করা।
৫. এই নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যমূলক কিনা তা যাচাই করা।
৬. এবং আরোপিত নিয়ন্ত্রণ হুমকির তুলনায় সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং এর মধ্য দিয়ে সমস্যার কার্যকর সমাধান পাওয়া যাবে কিনা তা বিবেচনা করা।
মানবাধিকারের সাথে সঙ্গতি রক্ষার জন্য আদালত যে সকল যুক্তি ও কার্যকারণ ব্যবহার করে থাকে সেগুলো যখন আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারব তখন আমরা আরও কার্যকরভাবে আমাদের অধিকার দাবী করতে পারব। এছাড়া আদালত ও সরকার এই বিষয়ে সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে কিনা বা তারা প্রকৃতপক্ষে ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে লংঘন করছে কিনা সে সম্পর্কিত বিতর্কেও আমরা পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারব।
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত এসএমসি ২০১৮
End of Transcript
8. ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ
অনেক সরকার ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। কিন্তু কীভাবে আমরা জানব এই নিয়ন্ত্রণ কখন সমর্থনযোগ্য ও অনুমোদনযোগ্য এবং কখন নয়? মানবাধিকার সনদগুলোতে উল্লিখিত নিয়মগুলোকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেগুলো ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা বাস্তবায়নের জন্য আইনপ্রণেতা ও আদালতের অনুসরণ করা উচিত।